সীমান্তের ৩০ পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা আনছে রোহিঙ্গারা

বাংলানিউজ

দেশব্যাপী মাদকের বিরুদ্ধে তৎপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যার জেরে ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারাদেশে শুরু হয় মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান। বিশেষ অভিযান শুরুর পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’সহ বিভিন্ন ঘটনায় এখন পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় নিহত হয়েছেন দুই নারীসহ ১৫৭ জন মাদককারবারি। যাদের মধ্যে এক নারীসহ ৩৫ জনই রোহিঙ্গা নাগরিক।

অর্থাৎ মানবতার খাতিরে এদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই এখানে এসে করছে মাদকের কারবার। প্রায় প্রতিদিনই র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি), পুলিশ, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের হাতে ইয়াবাসহ ধরা পড়ছে রোহিঙ্গারা।

যদিও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাদকের বিরুদ্ধে তৎপর। কিন্তু এরপরেও বন্ধ করা যাচ্ছেনা ইয়াবা পাচার। 

স্থানীয়দের ভাষ্য, মাদক বিক্রি এখন রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে। উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি শরণার্থী শিবির এখন পরিণত হয়েছে ইয়াবার ‘নিরাপদ জোনে’। উখিয়া-টেকনাফের অন্তত ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নিয়ে আসে। এরপর এগুলো ক্যাম্পে মজুদ করে। পরবর্তীতে সেখান থেকেই সুবিধাজনক সময়ে দেশের বিভিন্নস্থানে পাচার করা হয় এসব ইয়াবা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ছবি: বাংলানিউজ

ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, রোহিঙ্গা ক্যম্পে কিছু কিছু রোহিঙ্গা মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে অস্ত্র, মানবপাচার, মাদক, অপহরণ, ডাকাতি, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে ৪৭১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে এক হাজার ৮৮ রোহিঙ্গাকে। মামলাগুলোর মধ্যে ২০৮টিই মাদক মামলা। এসব মাদক মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৬৮ জনকে।

এছাড়া অন্যান্য মামলার মধ্যে রয়েছে- অস্ত্র মামলা ৩৬টি, হত্যা মামলা ৪৩টি, ফরেনার্স অ্যাক্টে ৩৭টি, ডাকাতি নয়টি, পুলিশের ওপর হামলা একটি, অপহরণ ১৫টি, মানবপাচার ২৪টি, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা ৩১টি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে ২১টিসহ বিভিন্ন অপরাধে আরও ৪৬টি মামলা হয়েছে।

তবে স্থানীয়রা বলছেন, মাদক পাচার বা মাদক ব্যবসার অভিযোগে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২০৮টি মামলা হলেও বাস্তবে এ চিত্র আরও অনেক বেশি ভয়াবহ। বর্তমানে ক্যাম্পগুলো মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

বাস্তব চিত্র জানতে সীমান্ত এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলা হয়। খোঁজ নেয় সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতির।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের মধ্যে টেকনাফে নাফ নদী ও পাহাড়ি সংলগ্ন বালুখালী কাটা পাহাড়, ধামনখালী, রহমতের বিল, আনজুমান পাড়া, ডেইল পাড়া, পূর্ব ডিগলিয়া ও চাকবৈটা-করইবনিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশফাঁড়ি, আমতলী গর্জনবুনিয়া, ফাত্রাঝিরি, তুমব্রু ও ঘুমধুম এবং টেকনাফের উলুবনিয়া, হউসের দিয়া, উনচিপ্রাং, হ্নীলা, লেদা, মোচনী, ট্রানজিট ঘাট, দমদমিয়া, সাবরাং, খুরের মুখ, শাহপরীর দ্বীপ, লম্বা বিলসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে নিয়ে আসছে।

উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী এখন নানান সমস্যায় জর্জরিত। এমন অবস্থা চলমান থাকলে স্থানীয়দের উদ্বাস্তু হতে হয়তো বেশিদিন সময় লাগবেনা।

তিনি বলেন, নানা অপরাধের পাশাপাশি রোহিঙ্গারা এখন ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। যে কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এত কড়াকড়ির পরও ইয়াবা পাচাররোধ করা যাচ্ছেনা। এটা আমাদের জন্য আরেকটা হুমকি। 

‘রোহিঙ্গাদের কারণে সমাজে নানা অস্থিরতা তো আছেই, এই ইয়াবার কারণে এখন পারিবারিক কলহ, সামাজিক বিবাদ ও বিশৃঙ্খলা দিনকে দিন বাড়ছে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর উখিয়া শাখার সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিকদার জানান, উখিয়ার বালুখালী, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, টেকনাফের লম্বাবিল, উলুবুনিয়াসহ বেশ কিছু সীমান্ত পয়েন্ট আছে, যেগুলো রোহিঙ্গা শিবিরের সঙ্গে একদম লাগোয়া। এসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা নিয়মিত মিয়ানমারে যাতায়াত করে।

‘এমনকি প্রতি রাতেই রোহিঙ্গারা এসব পয়েন্ট দিয়ে বিপুল সংখ্যক ইয়াবা নিয়ে আসে এবং আশপাশের ক্যাম্পের ভেতরে মজুদ করে। সেখান থেকে রোহিঙ্গা গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণে দেশের বিভিন্নস্থানে এগুলো পাচার করা হয়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারদলীয় এক নেতা জানান, ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসন নিয়ে সরকার যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি সাধারণ মানুষের মাঝেও উৎকণ্ঠার শেষ নেই। কিন্তু ইয়াবা পাচারের এসব ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর ইন্ধন থাকায় এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছেনা।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন আরও বলেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেই রোহিঙ্গাদের এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতি যথেষ্ঠ আন্তরিকতাও দেখাচ্ছে সরকার।

‘কিন্তু এরা যদি নানা অপরাধে জড়িয়ে গিয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি নষ্ট করে, তাহলে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে। ইতোমধ্যে তাদের অপরাধ দমনে এবং ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’